পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা শুরু করেছিলেন সেই ১৯৯৬ সালে। সময়ের আবর্তে অভিহিত হয়েছেন পাকিস্তান ঘরোয়া সার্কিটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে। ১৬৯টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। একটি ট্রিপল সেঞ্চুরিসহ রান করেছেন ৭ হাজার ৫১৫। দিনের পর দিন ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম করে গেছেন, কিন্তু কখনোই সুযোগ হয়নি পাকিস্তান দলে। কিন্তু তিনি ভরসা রেখেছেন নিজের ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের প্রতি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ১৯ বছরের মাথায়, ৩৯ বছর বয়সে তাঁর সুযোগ হয়েছে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার।
দুবাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে পাকিস্তান দলে সুযোগ মিলেছে রাফাতউল্লাহ মোহমান্দের। পাকিস্তান ঘরোয়া ক্রিকেটে দিনের পর দিন পারফরম করেও সুযোগ পেতে তাঁর লেগে গেল এতগুলো বছর। হতাশ হয়েছেন দিনের পর দিন, খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন, কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ক্ষমতা আর প্রতিভার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন তিনি। নতুন করে প্রতিজ্ঞা সাজিয়েছেন, তাঁকে যে পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলতে
হবেই।
৩৯ বছর বয়সে অভিষিক্ত হয়ে অন্য রকম একটা রেকর্ডই করে ফেলেছেন রাফাতউল্লাহ। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষিক্ত খেলোয়াড়দের মধ্যে তাঁর অভিষেকটাই হয়েছে সবচেয়ে বেশি বয়সে। এমন একটি রেকর্ড গড়ে অবশ্য খুব একটা অখুশি নন এই পাঠান ক্রিকেটার, ‘অভিষেকটা দেরিতে হয়েছে, সন্দেহ নেই। আরও আগেই আমার পাকিস্তান দলের জার্সি পরা উচিত ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। ৩৯ বছর বয়সে আমার এই অভিষেকের বিষয়টা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের উদাহরণ হয়েই না হয় রয়ে গেল।’
দিনের পর দিন ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম করে যান, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ মেলে না—ক্রিকেট দুনিয়ায় এমন অনেক ক্রিকেটারের উদাহরণই খুঁজে পাওয়া যাবে। নিজের অভিষেককে এমন সব ক্রিকেটারদের সাহস জোগানোর অনুষঙ্গ হিসেবেই মনে করেন রাফাতউল্লাহ। তিনি মনে করেন, ‘কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে ভালো ভালো পারফরম্যান্স সবার নজরে পড়তে বাধ্যই।’
১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই ‘ভালো খেলোয়াড়’ হিসেবে পরিচিতিটা রাফাতউল্লাহ পেয়ে যান বেশ দ্রুতই। ২০০৫ সালে তাঁর সামনে সুযোগ আসে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়ানোর। সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ টেস্টের এক সিরিজে তাঁর সুযোগ হয় পাকিস্তানের প্রাথমিক দলে। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের পরেও তিনি সেবার ব্যর্থ হন প্রয়াত কোচ বব উলমারের দৃষ্টি কাড়তে।
ব্যাপারটা রাফাতউল্লাহর জন্য ছিল চূড়ান্ত হতাশার। মনে মনে বেশ দমে গিয়েছিলেন তিনি, ‘এত পরিশ্রম করলাম, এত পারফরম করলাম, তাও সুযোগ মিলল না!’ কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে নতুন করে নিজেকে তৈরি করতে থাকেন তিনি। এভাবে পেরিয়ে যায় আরও চারটি বছর।
২০০৮ সালে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে এক অনন্য রেকর্ডের অংশীদার হন রাফাতউল্লাহ। পাকিস্তান ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের হয়ে আমির সাজ্জাদ নামের এক ব্যাটসম্যানের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে রাফাতউল্লাহ গড়েন ৫৮০ রানের এক জুটি। সেই জুটিতে তাঁর অবদান ছিল ৩০২।
এমন পারফরম্যান্সের পর তিনি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন তিনি আবার পাকিস্তান দলে ডাক পাবেন। কিন্তু হায়! সেই ডাক আর আসেনি। এই সময় হতাশায় ভেঙে পড়েন রাফাত। ক্রিকেট ছাড়ার পাশাপাশি দেশছাড়ার কথাও ভাবতে থাকেন। সুযোগ আসে তাঁর আফগানিস্তান দলের হয়ে খেলারও।
২০০৯ সালে আফগানিস্তানের কোচ কবির খান তাঁকে প্রথম এই প্রস্তাবটি দেন। রাফাতউল্লাহ নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজিও হয়ে যান। কিন্তু এখানেও হতাশা। দেশ পরিবর্তন করতে হলে নতুন দেশে কমপক্ষে চার বছর থাকার যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেই আইনের জালে আটকা পড়ে যান তিনি। আফগানিস্তানের হয়ে খেলার সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যায় তাঁর।
গত সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের জাতীয় টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত খেলেন রাফাতউল্লাহ। ৭ ম্যাচে করেন ২৩০ রান। গড় ছিল ১৫৭.৫৩। তাঁর আক্রমণাত্মক ঢংয়ে ব্যাটিং নজর কাড়ে সবারই। এই প্রতিযোগিতাটি বদলে দেয় তাঁর ভাগ্যের দৃশ্যপট। সুযোগ এসে যায় তাঁর পাকিস্তান জাতীয় দলের জার্সি পড়ে মাঠে নামার।
মাঠে নেমে রাফাতউল্লাহ পেছনে ফেলেছেন রাহুল দ্রাবিড়কে। হ্যাঁ, ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড়কেই। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এই দ্রাবিড়ই রাফাতউল্লাহর আগে ছিলেন সবচেয়ে বেশি বয়সে অভিষিক্ত। ৩৮ বছর ২৩২ দিন বয়সে তিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন। রাফাতউল্লাহ রাখলেন ৩৯ বছর বয়সে।
অধ্যবসায়ের সমাপ্তি হয়েছে ১৯ বছর পর। এবার নিজেকে প্রমাণের পালা তাঁর। কিছু মানুষ আছেন, গোটা জীবনটাই যাদের পরীক্ষার ক্ষেত্র। পাখতুনখোয়ার এই রাফাত খুব সম্ভবত তাদেরই একজন। তথ্যসূত্র: এএফপি।